আমরা মারার জন্য দেশ বানাইনি, গড়ার জন্য বানিয়েছি : ড. ইউনূস
সংবাদমাধ্যমের শক্তিকে মহান উল্লেখ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আপনারা সংবাদমাধ্যম, আপনাদের মাধ্যমেই আমরা আবু সাঈদের গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার খবর জানতে পেরেছি। আপনাদের মহান শক্তি। এই শক্তিটাকে প্রয়োগ করে কীভাবে জাতিকে একত্র করা যায়, এক পরিবার বানানো যায়, কেউ কাউকে মারার জন্য নয়। আমরা মারার জন্য দেশ বানাইনি গড়ার জন্য দেশ বানিয়েছি। এই জিনিসটা পরিষ্কার করার জন্য আপনাদের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া।
শনিবার (১০ আগস্ট) বিকেলে রংপুর সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে সেখানে তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, রংপুরে বহুবার এসেছি। বহুদিন থেকে আমি রংপুরের সাথে সংযুক্ত। এর আগে এ রকম ভারি মনে রংপুর আসিনি কোনো দিন। রংপুরের দারিদ্র, দুরাবস্থা ক্রমাগতভাবে দেখে গেছি। আজকে যে কারণে আসলাম, রংপুরের একটি ছেলে (আবু সাঈদ) সারা বাংলাদেশকে পাল্টিয়ে দিয়েছে। শুধু বলেছে আর না, তুমি যতই অত্যাচার কর আমি আছি। সে বুক পেতে দিয়েছে অত্যাচারকে গ্রহণ করার জন্য। তার বুক ছিঁড়ে গুলি চলে গিয়েছে। এই আত্মত্যাগ সারা বাংলাদেশকে জাগিয়ে দিয়েছে। একটা ঘটনা, প্রতিবাদ। তার তো আর কিছু করার নেই নিজের শরীর ছাড়া, সেই শরীরটা দিয়েই সে প্রতিবাদ করেছে আত্মাহুতি দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা অত্যাচারীর ভূমিকায় সবাই। সেই ভূমিকা পরিবর্তন করতে হবে। আমরা ন্যায়বিচার সভ্যতার কথা বলি কিন্তু সেগুলোর অভাব ছিল। যা আবু সাঈদ সবার সামনে তুলে ধরল। কী রকম অবিচার মানুষ মানুষের ওপরে করতে পারে। আমরা তার কারণে আজকে দ্বিতীয় বিজয়ের কথা বলছি। যে কারণে রংপুরের দিকে সারা বাংলাদেশের মানুষ তাকিয়ে আছেন, সালাম দিচ্ছেন। তোমরা আমাদেরকে জাগিয়ে দিয়েছো। সারা পৃথিবী রংপুরকে সম্মান করছে। এ রকম প্রতিবাদী যুবক এখানে কীভাবে জন্ম নিল? আমরা বলছি যে মহাকাব্য পড়ি। মহাকাব্যের নায়ক-নায়িকাদের বলি, আবু সাঈদ এই মহাকাব্যের নায়ক। সে নিজেই রচনা করে দিয়ে গেছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আবু সাঈদ একটা পুরো জাতিকে জাগিয়ে দিয়েছে। দুঃস্বপ্ন ও বর্বরতা থেকে জাগিয়ে দিয়েছে। আমরা একটা বর্বর জাতি হয়ে গেছি। সে এটা দেখিয়ে গেল আমরা কত বর্বর হতে পারি। আমরা স্বাধীন-মুক্ত জাতি বলতেছি। এসব ফাঁকা কথা। আমরা বর্বরতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। এই বর্বরতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কী উপায়, সেটা জানার জন্য রংপুরে এসেছি আবু সাঈদের কাছাকাছি। তার কাছে আমরা মাফ চেয়েছি তোমাকে বর্বরতা থেকে মুক্তি দিতে পারিনি। ভবিষ্যতে যেন এটা আর না হয়, এটাই আমাদের বিষয়।
নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আমরা একটা পরিবার। সবাই সবাইকে রক্ষা করব, সবাইকে সবার থেকে ওপরে উঠার চেষ্টা করব এবং যারা অপরাধী তাদের বিচার আমাদের করতেই হবে। তা না হলে এর থেকে মুক্তি পাব না। কাজেই অপরাধীর আমরা বিচার করব। যে নিরাপরাধ তার ওপরে কোনো রকমের একটা অপবাদ লাগিয়ে দিয়ে অত্যাচার করে আমরা যেন আবার বর্বরতার দিকে না যাই। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সময় পালন করছি। প্রতিটা মুহূর্তই গুরুত্বপূর্ণ। সবাই যেন আমরা একত্রিত হতে পারি। কেউ আমাদের বিদেশি আক্রমণকারী না। আমরা আমরাই, আমরা গলাগলি করে বাঁচতে চাই। সব মতের মানুষ যেন আমরা এক হই। সে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান যাই হোক আমরা একই পরিবার। এখন শুনছি বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-হিন্দু এটা নিয়েও আবার মারামারি চলছে। এটা যেন না হয়। কোনো ধর্মের উছিলা করে কারো ওপর কেউ যেন অত্যাচার করতে না পারে সেজন্য রুখে দাঁড়াতে হবে। যা হয়ে গেছে সেটা থেকে আমরা মুক্ত হতে চাই। আমাদের পরিষ্কার করে ফেলতে চাই। আমরা নতুন করে পুনর্জন্ম লাভ করতে চাই।
এই জাতির সারা পৃথিবীতে ভাবমূর্তি যেভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে, সে অবস্থা থেকে কী থেকে আবার বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে? এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, এই জাতির সম্ভাবনা অসীম। এই জাতির যে তরুণ সম্প্রদায়, তার যে সৃজনশীলতা উদ্যোম, অন্য জাতির তুলনায় অনেক অনেক বেশি। এতটুকু জায়গার মধ্যে আমরা ১৭ কোটি মানুষ থাকি। এই ১৭ কোটি মানুষকে আমরা আরও ওপরে নিয়ে যেতে পারি। শুধু এই গুতাগুতি মারামারি খুনাখুনি থেকে বাঁচতে হবে। অন্যরা কী দেখলো সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো আমরা নিজেদেরকে কী দেখতে চাই। আমাদের স্বপ্নটা কী সেটা যদি আমরা বাস্তবায়ন করি, তাহলে পৃথিবীর মানুষ এমনি বাহাবা দেবে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবর্তন ও স্বাধীনতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওগুলো সব নষ্ট হয়েছে বলেই তো আজকে আমরা দুঃখের মধ্যে। কাজেই এসব পরিষ্কার না করলে আবার বর্ববতার মধ্যেই থাকতে হবে। কাজেই এটা পরিষ্কার করতে হবে। এটার কোনো বিকল্প নেই। পচা জায়গায় নতুন তরতাজা জাতি তৈরি করতে হবে। এটা আমরা পারি। শুধু আমাদের সবাইকে একত্রিত হতে হবে। বিষ থাকলেই বিপদ। নিজেদের মধ্যে একতাটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে সবকিছুই সম্ভব।
নির্বাচন প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এখনো আলাপ আলোচনা হয়নি। কতদিনে হলে ভালো হয় সেটা নিয়ে সবার মতামত নেওয়া হবে। যেটা ভালো হয় সেটাই করা হবে। তিনি বলেন, রংপুর একটা পিছিয়ে পড়া জেলা। এই জেলাকে এগিয়ে নিতে হবে। রংপুর বাংলাদেশের এক নম্বর জেলা হোক, এটাই প্রত্যাশা।
এর আগে শনিবার (১০ আগস্ট) সকালে হেলিকপ্টারযোগে রংপুরের পীরগঞ্জে আসেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে জাফরপাড়ায় আবু সাঈদের বাড়িতে গিয়ে তার কবর জিয়ারত করে পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর নেন। পরে সেখান থেকে তিনি আসেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কসহ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। পরে আহতদের দেখতে রংপুর মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে যান। এরপর রংপুর সার্কিট হাউসে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মতবিনিময়কালে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, তোমরা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের নিরাপদে রাখবা। বলবা, সবাই আমরা ভাই। বাংলাদেশ এক পরিবার। পৃথিবীতে বহু দেশ আছে, এত সুন্দর পরিবার নাই। এত সুন্দর একটা দেশ, কোথায় চলে যেতে পারতাম আমরা! শুধু মনটা শক্ত রাখতে পারলে হতো। আর তোমাদের (তরুণ) রাস্তা খুলে দিলে আমরা মুক্ত হয়ে যেতাম।
সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা কি দেশের মানুষ না? তারা কয়টা পরিবার? পুরো দেশ রক্ষা করতে পারছো , আর এ কয়েকটা পরিবারকে তোমরা (শিক্ষার্থীরা) রক্ষা করতে পারবা না? এরা তোমাদের সাথেই আন্দোলনে ছিল। বাড়ি গিয়ে দ্যাখে তার ঘর লুটপাট হয়ে গেছে। এগুলো ‘লুটপাটওয়ালা’দের কাজ।
ড. ইউনূস বলেন, কিছু ব্যক্তি অন্যের মদদে সহিংসতা করছে। গোলমাল লাগাতে পারলে তাদের খুব মজা। সব সময় তারা চেষ্টায় আছে তোমাদের আটকে দেওয়ার জন্য। নতুন বাংলাদেশ তরুণদের বাংলাদেশ। তরুণদের এখন কেউ টেনে রাখতে পারবে না। পথ পরিষ্কার করতে হবে। বেগম রোকেয়া নারীদের মুক্ত করেছেন। এখন রংপুর পুরো বাংলাদেশ মুক্ত করবে। এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, রংপুর বিভাগীয় কমিশনার জাকির হোসেন, ৬৬ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আখতার হোসেন, সমন্বয়ক সারজিস আলমসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সামনের সাড়িতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন আবু সাঈদ। গত ১৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন পার্ক মোড়ে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ। পরদিন ১৭ জুলাই তাকে পীরগঞ্জ উপজেলার মদনখালী ইউনিয়নের বাবনপুর গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়। বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন আবু সাঈদ।
দৈনিক পুনরুত্থান /
আপনার মতামত লিখুন: