তিস্তার পানি দিয়ে ভারতকে ‘বন্ধুত্বের’ প্রমাণ দিতে বলল বাংলাদেশ

৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক। তবে দিল্লি বলছে, দুই নিকট প্রতিবেশীর সম্পর্ক খারাপ হয়নি। যদি এমনটাই হয়ে থাকে তবে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সই করার মধ্য দিয়ে ভারতকে বন্ধুত্বের প্রমাণ দিতে বলেছে বাংলাদেশ।


চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে ওমানের রাজধানী মাস্কটে ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলনের ফাঁকে বৈঠক হয় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের মধ্যে। ওই বৈঠকে তিস্তার জট খুলে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে অনুরোধ করেছেন তৌহিদ হোসেন। নির্ভরযোগ্য কূটনৈতিক সূত্রগুলো থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, গত রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলনের ফাঁকে মাস্কটে আধা ঘণ্টারও কম সময় বৈঠক করেন তৌহিদ-জয়শঙ্কর। বৈঠকে উভয়পক্ষ দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্ক আরো ভালো হওয়া দরকার। জবাবে জয়শঙ্কর বলেছেন, আমাদের সম্পর্ক খারাপ হয়নি, এটা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যার দ্রুত সমাধানে ভারতকে অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সই করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ভারতকে। ঢাকা বলেছে, তিস্তার জট খোলা খুব কঠিন হবে না। আর এটি হলে বাংলাদেশে অনেক বড় প্রভাব পড়বে। মানুষ বিশ্বাস করবে ভারত বাংলাদেশের বন্ধু।
স্থানীয় এক কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নির্দিষ্ট সরকারকেন্দ্রিক হউক, সেটি ভারতকে বড় কোনো সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত একটি ইস্যু আমাদের মধ্যে আছে, সেটা হলো তিস্তা। ভারত সরকার যদি তিস্তার বিষয়ে এগিয়ে আসে তাহলে পুরো দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে যাবে। তখন মানুষ বিশ্বাস করবে ভারত বাংলাদেশের বন্ধু। সুসম্পর্ক রাখার জন্য তো প্রমাণ দিতে হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, তিস্তা নিয়ে দিল্লি আর কলকাতা রাজনীতি করছে। কলকাতা বলছে দিল্লি, দিল্লি বলছে কলকাতা— এটা পুরো রাজনীতির খেলা। তাদের কেউ-ই সমস্যার সমাধান করবে না। আমার মনে হয় নতুন করে চিন্তা করতে হবে। কারণ, বছরের পর বছর আশ্বাসে থেকে আমরা লাভবান হচ্ছি না। এক দশকের বেশি সময় তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি আটকে আছে দিল্লির আশ্বাসের বৃত্তে। তিস্তার এ জট খোলার বিষয়ে বারবার আশ্বস্ত করেছে ভারত। কিন্তু সেই আশ্বাস পর্যন্তই, যে বৃত্তে আটকে আছে বহুল প্রত্যাশিত চুক্তি; সেটি কোনোভাবেই ভাঙছে না।


তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের (প্রয়াত) বাংলাদেশ সফরকালে চুক্তিটি স্বাক্ষরের বিষয়ে সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করা হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে শেষ মুহূর্তে আটকে যায় এটি। সেই মমতা এখনও বাধা হয়ে আছেন। তাকে বাগে আনতে পারেনি মোদি সরকার-এমন বার্তাই বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে শুনেছেন বাংলাদেশের জনগণ।
৮ আগস্ট বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর গত সেপ্টেম্বরে তিস্তা নিয়ে কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বার্তা সংস্থা পিটিআইয়ের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়ে মতপার্থক্য দূর করার উপায় নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করবে অন্তর্বর্তী সরকার। বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে, এতে কোনো দেশেরই লাভ হচ্ছে না। সম্প্রতি তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ও মেগা প্রকল্প অবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবিতে গণপদযাত্রা কর্মসূচি পালন করেছেন আন্দোলনকারীরা। তারা তিস্তায় নেমে ভারতের পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদ করেছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে তিস্তা ইস্যুতে বেশ সরব দেখা গেছে। ভার্চুয়াল এক অনুষ্ঠানে সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, তিস্তা চুক্তি করতে ভারত যদি অনীহা প্রকাশ করে, তাহলে দেশ ও জনগণের স্বার্থে কৃষি, কৃষক ও নদী বাঁচাতে তিস্তা সমস্যার সমাধানের জন্য আমাদেরই বাঁচার পথ খুঁজে নিতে হবে।
কূটনৈতিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে ঢাকা-দিল্লির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অস্বস্তি তৈরি হয়। বিশেষ করে, বাংলাদেশে ভারতের সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ এবং কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলার ঘটনা যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো পরিবেশ তৈরি করে। তবে গত বছরের ডিসেম্বরে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রির ঢাকা সফরের পর দুই দেশের সম্পর্ক অনেকটাই শীতল হয়। তার এ সফরের পর গত ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ ভারতীয় জেলে ও ভারত বাংলাদেশি জেলেদের মুক্তি দিয়ে নিজ দেশে ফেরত পাঠায়। ওই সময় ১৮৫ জন মুক্তি পান। এছাড়া দুই দেশই জেলেদের আটক করা নৌযানও ফেরত দেয়।
তবে এই ‘শীতল সম্পর্ক’ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। জানুয়ারির মাঝামাঝিতে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণসহ সীমান্তের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আবার দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। সে সময় ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে বাংলাদেশ। এর ২৪ ঘণ্টা না যেতে ভারতও নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনার নুরাল ইসলামকে তলব করে। সেগুলোর রেশ কাটতে না কাটতেই আসে শেখ হাসিনার বক্তব্য ইস্যু। হাসিনার বক্তব্যের কারণে দেশে নতুন করে আবারও অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে— এমনটি জানিয়ে ভারতের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করে প্রতিবাদ জানায় ঢাকা। এরপর বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করে দিল্লি।
শুধু এতে থেমে থাকেনি ভারত। তারা ঢাকার ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয়। কিন্তু নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের এমন প্রতিক্রিয়া ভালোভাবে নেয়নি ঢাকা। এমন পরিস্থিতির মধ্যে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি মাস্কটে বৈঠক করেন তৌহিদ-জয়শঙ্কর। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মাস্কটের বৈঠকে জয়শঙ্কর ঢাকার ধানমিন্ডতে শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙার প্রসঙ্গ তুলেছেন। ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রী বলেছেন, মুজিবরের বাড়ি ভাঙা হয়েছে, এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়; তবে এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। জবাবে তৌহিদ বলেছেন, বাংলাদেশে একটা অভ্যুত্থান হয়েছে। অভ্যুত্থান পরবর্তীতে এ ধরনের ঘটনা সব দেশেই হয়ে থাকে।


বৈঠকে সীমান্ত হত্যা নিয়ে আলোচনা হয়। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশটি সীমান্ত হত্যা চায় না। এছাড়া, আলোচনায় আগামী এপ্রিলে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অনুষ্ঠেয় বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক আয়োজনের প্রসঙ্গটি এসেছে। মাস্কটে তৌহিদ-জয়শঙ্করের বৈঠকের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, তা স্বীকার করে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করার ওপর জোর দেয়। তৌহিদ হোসেন দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি নবায়নের আলোচনা শুরুর ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি সার্ক স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠক আয়োজনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি বিবেচনার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ জানান।
বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে এক পোস্টে বলেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। আলোচনায় অগ্রাধিকার ছিল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, যার মধ্যে বিমসটেক ছিল।
দৈনিক পুনরুত্থান /
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আপনার মতামত লিখুন: